কাজী শওকত হোসেন : বিশ্বের সর্ব র্বহৎ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ভারতবর্ষ। ১৩০ কোটি জনসংখ্যার দেশ ৯০ কোটি ভোটার। কম বেশী সকল ধর্মের মানুষ বসবাস করে দেশটিতে। বহু ভাষা, বর্ণ, জাতি প্রথায় বিভাজন ভারত। ১১ই এপ্রিল থেকে ১৭তম লোকসভা নির্বাচন শুরু হয়ে সাত দফায় ১৯শে মে পর্যন্ত ছোট-খাট সংঘর্ষ ছাড়া শান্তিপূর্ণ পরিবেশে লোকসভা নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে।
তাদের নির্বাচন কমিশন অত্যন্ত দায়িত্বশীল ও শক্তিশালী, ন্যায়পরায়ন, দক্ষতা, সততা, নিরপেক্ষতা ও কার্যকর ভুমিকা পালনে মাধ্যমে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকাররী বাহিনীর নিরপেক্ষ অবস্থান প্রিজাডিং অফিসারদের আন্তরিকার সাথে অর্পিত দায়িত্ব পালন এই বিশাল নির্বাচন মহাযজ্ঞ, সুষ্ঠ, অবাধ ও নিরপেক্ষভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছে। সংবাদকর্মী, ইলেকট্রনিক্স মিডিয়া, সর্বপরি জনগণ নির্ভয়ে ভোট প্রয়োগের মাধ্যমে তাদে স¦াধীন মত প্রকাশের এবং রাজনৈতিক দলগুলির ফলাফল মেনে নেওয়ার মানসিকতা ভোটে পরাজিত দল ও নেতৃত্ব বিজয়ী দলকে কাল বিলম্ব না করে জনগণের রায়কে স¦ীকৃতি প্রদান এবং বিজয়ী দল ও নেতৃত্ব সকলকে নিয়ে কাজ করার অঙ্গীকার প্রদান এটাই গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। নির্বাচনের আসন ৫৪৩, নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে ৫৪২ আসনে। একটি আসনে নির্বাচনের আগেই অস্ত্র ও অর্থ রাখা অপরাধে নির্বাচনের আসনটি স্থগিত ঘোষনা করা হয়েছে।
২৩শে মে নির্বাচনের ফলাফলে মোদির নেতৃত্বে বিজেপি (এনডিএ) জোট ৩৫২টি আসসে বিজয়ী হয়েছে, কংগ্রেসের নেতৃত্বে জোট ৯২ আসন, অন্যান্য ৯৮ আসনে বিজয়ী হয়ে বিরোধী দলে অবস্থান হয়েছে। মোদি দ্বিতীয়বার এবং ভারতের ১৫তম প্রধানমন্ত্রী হিসাবে চলতি মাসের মধ্যেই সরকার গঠন করবেন। ভারত ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগষ্ট ব্রিটিশদের কাছ থেকে স¦াধীনতা লাভের পর গান্ধীজির নেতৃত্বে গণতন্ত্রের জন্য তারা চ্যালেঞ্জিং যাত্রা শুরু করে। আজ তারা বিশ্ব মানচিত্রে শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসাবে ভারতকে গড়ে তুলতে পেরেছে। একই সাথে ১৪ই আগষ্ট পাকিস্তানও স¦াধীন হয়েছিল। কিন্তু তারা সামরিকতন্ত্রের বেড়াজাল থেকে গণতন্ত্রে উত্তোরণ ঘটাতে পারে নাই। যার ফলে ২৩ বছর বাঙ্গালীদের উপর সীমাহীন অত্যাচার নির্যাতনের ফলে ৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে স¦াধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্ম হয়। ভারত রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামরিক, শিক্ষা, কৃষি, আইটি, শিল্প উৎপাদনে অবকাঠামোগত উন্নয়ন সহ প্রায় সকল ক্ষেত্রে উন্নতি লাভ করেছে। এর পরও ভারতে ব্যাপক শ্রেণী বৈষম্য বিরাজমান তাদের সমাজ ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায়। ভারতে জাত পাতের বৈষম্য আছে, ছিল এবং থাকবে। এর পরও ঐক্যবদ্ধ ভারত তাদের কাম্য। কাষ্মীর সমস্যা নাগাল্যান্ডে, ঝারখন্ড সহ অনেক রাজ্যে অস্থিতিশীল পরিবেশ মাঝে মাঝে মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। জাতীয় স¦ার্থে ১৭তম লোকসভায় কংগ্রেস ও আঞ্চলিক বিরোধী দলের ভরাডুবির পরও রাহুলগান্ধী ও মমতা ব্যানার্জি মোদিকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। তারা দুজনই দলের নেতা, কর্মী সমর্থকদের আস্থা, বিশ্বাষ রাখার জন্য ধৈর্য্য ধরতে বলেছেন, যা আমাদের দেশে বিরল।
এবারের নির্বাচনে ইভিএম ব্যাবহার নিয়ে বিরোধী দলগুলো অভিযোগ তুললেও ফলাফল ঘোষনার পর তা বুদবুধের মত মিলিয়ে গিয়েছে। ২০১৪ সালে বিজেপির নেতৃত্বে ২৮৩ আসন পেয়েছিল নরেন্দ্র মোদির দল। এবার পেয়েছে ৩৫২ আসন, ঐ নির্বাচনে কংগ্রেস পেয়েছিল ৬০টি আসন। পশ্চিম বঙ্গের ৪২ আসনের মধ্যে ২৪টি মমতা ব্যানার্জির তৃনমুল, বিজেপি পূর্বের ২টি থেকে এবার ১৮টি পেয়েছে। মমতা ব্যানার্জি সরকার গঠন করলেও বিধান সভায় আগের মত দাপট দেখাতে পারবেন না। তিস্তা নিয়ে তার বাড়াবাড়ির তিনি উচিৎ জবাব পেয়েছেন। পশ্চিম বাংলার মানুষ তার উদ্বত্যপনা ভালভাবে গ্রহণ করে নাই ভোটের ফলাফলেই তার প্রমাণ। মায়াবতী, নীতিশ, মমতা তাদের প্রত্যাশা অনুযায়ী আশানুুপরুপ আসন লাভ করতে পারেন নাই। আঞ্চলিক দলের ভরসায় কংগ্রেস হয়তো কোয়ালিশন সরকার করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তা আর হয়ে উঠে নাই। বিরোধী দলের ঐক্যে টানা পুড়ন, একে অন্যের বিরুদ্ধে কথা বলা, কোথাও কোথাও জোটে অন্তর্ভূক্ত না হওয়া। বিরোধী দল জয়ী হলে কে হবে তাদের প্রধানমন্ত্রী সেটি তারা স্পষ্ট করতে পারে নাই। শুধু মোদি ও বিজেপির বিরোধীতা তেমন কাজে আসে নাই। রাহুল উচ্চ শিক্ষিত হলেও বয়সে তরুন ও অভিজ্ঞতা কম, কংগ্রেসের নেতৃত্বও অতীতের তুলনায় দুর্বল। তাদের জোটও ছিল আগোছালো, কংগ্রেসের ধর্ম নিরপেক্ষ রাজনীতি হিন্দুত্ববাদীদের সাম্প্রদায়িক রাজনীতির কাছে মার খেয়েছে। মোদির নেতৃত্ব বয়স তার স¦প্ন দেখানোর সাহস ও শক্তি জাতীয় নেতৃত্ব দেওয়ার যোগ্যতা, তার অসামান্য বাগ্নিতা গুজরাটের মূখ্যমন্ত্রী থাকাবস্থায় রায়টের ভয়াবহতা তার বিরুদ্ধে দাঙ্গা-হাঙ্গামার অভিযোগ সব কিছুকে ছাপিয়ে দলের মধ্যে তার অনুসারি অমিত শাহ, রাজনাথ সিং সহ অনেক অভিজ্ঞ নেতাদের সাথে নিয়ে বিজেপি প্রধান ও এনডিএ জোটের নেতৃত্ব গ্রহ ও ভারতের প্রধান নেতা হিসাবে প্রতিষ্ঠা পাওয়া রাজনীতির দাবা চালে অপ্রতিদন্ধী হিসাবে অধিকাংশ ভারতীয়দের আস্তা অর্জন বিশ্ব রাজনীতিতে ভারতের অবস্থান ও গুরুত্ব।
চীন, পাকিস্তান, রাশিয়া, আমেরিকা, ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্যে শক্তিশালী অবস্থান গড়তে সমর্থ হয়েছেন। সাম্প্রতিক কালে সৌদী প্রিন্স সালমানের ভারত সফর ও সৌদী বিনিয়োগ তার নেতৃত্বের দুরদর্র্শিতা প্রমাণ করে। বাংলাদেশের সাথে ভারতের সমুদ্র সীমা স্থল সীমান্তের স্থায়ী সমাধান ও অন্যান্য বিষয়ে আগামী দিনগুলিতে সম্পর্কের আরও উন্নতি হবে। মমতা তিস্তা নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে, যে কারণে সমস্যাটির আজও সমাধান হয় নাই।শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতায় আসার পর বাংলাদেশের মাটিতে ভারত বিরোধী সন্ত্রাসী কর্মকান্ড বন্ধ হয়েছে, যা কি না ভারতের অন্ততঃ ৭টি রাজ্যে শান্তির সুবাতাস বইছে। কংগ্রেস ভারতের স¦াধীনতা লাভের জন্য মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে বিশাল ভুমিকা রেখেছেন। ৪০ বছর এক নাগারে দেশ াশসন করেছেন। তারপর জনতা পাটি মুরাদি দেশাইর নেতৃত্বে ক্ষমতায় আসেন। পরে অটল বিহারী বাজপেয়ী ক্ষমতায় আসেন এবং মাঝে কংগ্রেসের ড. মনমোহন সিং প্রধানমন্ত্রী হিসাবে ক্ষমতায় ছিল। এক সময় মমতা ব্যানার্জি কংগ্রেস নেত্রী ছিলেন। সেখান থেকে বেরিয়ে এসে তৃণমুল কংগ্রেস গঠন করে বিজেজির সাথে এলায়েন্সে অটল বিহারী বাজপেয়ীর সাথে জোট করে তার মন্ত্রী সভায় কেন্দ্রীয় রেল মন্ত্রী ছিলেন সেখানেও বনিবনা হয় নাই। পূণরায় কংগ্রেসের সাথে জোট করে জাতীয় রাজনীতিতে ভূমিকা রাখছেন। কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধী বিশাল গণতান্ত্রীক দেশ ভারতের এখনই প্রধানমন্ত্রীর মত এত বড় দায়ীত্ব দেখতে চায় না ভারতের অধিকাংশ মানুষ। তার আরও অভিজ্ঞতা ও বয়স, সময়, তার বিজ্ঞতা, বিচক্ষনতা, দুরদর্শিতা, তার দলিয় রাজনীতি, জোটের রাজনীতি, জাতীয় রাজনীতি চীন, পাকিস্তান ও আশেপারেশ ছোট বড় দেশের সাথে সম্পর্ক ভারতের অর্থনীতি সামরিক শক্তি সব কিছুর জন্যই তার আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।
প্রিয়াংকাকে রাহুলের জায়গায় আগেই সুযোগ দেওয়া উচিৎ ছিল বলে মনে হয়। তার পরেও রাহুল পূর্বের তুলনায় অনেক পরিপক্ক হয়ে উঠছেন ধীরে ধীরে। প্রিয়াংকা স¦ল্প সময়ে ৩৩টি সভা করেছেন তিনি। প্রত্যাশা অনুযায়ী ঝড় তুলতে পারেন নাই। ভোটের ফলাফল কংগ্রেসের ক্ষেত্রে খারাপ হয় নাই বলে মনে হয়। সোনিয়া গান্ধী শারীরিক অসুস্থতার কারণে রাজনীতি থেকে বিদায় নিয়ে ছেলেকে দায়িত্ব দিয়েছেন। তাছাড়া কংগ্রেসের নেতৃত্বে অনেক অভিজ্ঞ নেতার অভাব রয়েছে বিজেপির তুলনায়। বিজেপির রাজনীতিতে ধর্মীয় বিষয়ই মূল উপাদান হিসাবে প্রাধান্য পায়। ধর্মভীরু মানুষ সরল মনে তা গ্রহণ করেছে, ফলে গেরুয়াদের উত্থান হয়েছে। সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দল হিসাবে পরিচিত। অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি সারা বিশ্বেই মার খেয়ে যাচ্ছে। সাম্প্রদায়িক রাজনীতির আবির্ভাব গঠছে অনেক দেশে। বাম ঘরনার রাজনীতি বিরাট বিপর্যয় ঘটেছে। কোন আসনেই ১৬.৬% এর বেশী ভোট পায়নি নির্বাচন কমিশনের নিয়মানুযায়ী ভোটের প্রার্থীরা। নির্বাচনের সিকিউরিটি ডিপোজিট হিসাবে ২৫ হাজার টাকা করে পেয়েছিল কমিশনের তরফ থেকে। নিয়মানুযায়ী ১৬.৬% এর নিচে ভোট পেলে কমিশনকে ফেরৎ দিতে হবে এই টাকা। তারা সারা ভারতেই ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গিয়েছে। পশ্চিম বাংলায় দীর্ঘদিন বাম ফ্রন্ট ক্ষমতায় ছিল, এবার একটিও সিট পায় নাই। আমাদের দেশের বামরাও ভোটে জামানত হারায়।
নেহেরু পরিবার ৪০ বছরযাবৎ উত্তর প্রদেশের আমেথির আসন দ্বিতীয়বারের মত হারান।একবার ইন্দিরা গান্ধী রাজ নারায়নের কাছে পরাজিত হন। এবার রাহুল গান্ধী অভিনেত্রী শৃতি ইরানির কাছে পরাজিত হন ৫৫১২০ ভোটের ব্যবধানে। শৃতি ইরানি ২০১৪ সালে রাহুলের কাছে ১ লক্ষ ভোটে পরাজিত হয়েছেন। তারপরও তাকে বস্ত্রমন্ত্রীর দায়িত্ব দিয়েছিল মোদি। এবার তিনি সফল হয়েছে। রাহুল গান্ধী কেরালার ১টি আসনে জয়ী হয়েছেন। রায় বেরুলী থেকে তর মা সোনিয়া গান্ধী বিজয়ী হয়েছেন। কংগ্রেসের অনেক বড় বড় নেতা পরাজিত হয়েছেন ভারতের গেরুয়া রঙ্গের বসনধারী ধর্মীয় উম্মাদনায় বিশ্বাসী রাজনীতির ধারক বাহক নেতৃত্ব দানকারীরা গণতান্ত্রিক দেশ ভারতকে বহু জাতপাত, ধর্ম বর্নে অন্ততঃ ৮৩টি ভাষার মানুষের বসবাসেরশান্তির নিবাস হিসাবে থাকবে কি না বলা মুশকিল। থাকলে আশেপাশের ছোট বড় দেশের মানুষ ধর্ম বর্নের ভেদাভেদ ভুলে ঐক্যবদ্ধ বিশ্ব গড়তে বিশেষ ভুমিকা পালন করতে সক্ষম হবে, যা শান্তিপ্রিয় মানুষের কাম্য।
লেখক :
কাজী শওকত হোসেন
সহ সভাপতি-ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগ
কলামিষ্ট ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
Leave a Reply